বর্ষায় রূপ মেলে ধরেও, ভ্রমণ রসিক বাঙালির বিরহে-ই ‘ডুয়ার্স’
কল্যাণ অধিকারী
তিন-চারটে দিন ছুটি পেলেই দার্জিলিং মেল কিংবা পদাতিক এক্সপ্রেস নাহলে কাঞ্চনকন্যার টিকিট কাটতে দৌড় দেন বাঙালি। তারপর গাছের ছাওয়ায় আটকে পড়া সূর্যের আলোয় থমথমে জঙ্গলে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা আর রাতে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শোনা। ভ্রমণ রসিক বাঙালি ঘুরতে ভালবাসে না এমনটা অতি বড় নিন্দুকেও বোধহয় বলে না। সেই বাঙালি মাসের পর মাস ঘরবন্দি। ইচ্ছে থাকলেও চাইছেন না দূরে কোথাও ঘুরে আসতে।

অদূর ভবিষ্যতের কথা বাদ দিন। বছর টা আদৌ সুস্থতার মধ্য দিয়ে শেষ হবে তেমন বিশেষ কোন লক্ষণ নেই। জঙ্গল মানেই এডভেঞ্চার শব্দটা মন থেকে বিদায় নিচ্ছে। সেই কবে মার্চ মাস থেকে শুরু হয়েছে। তারপর এপ্রিল, মে একের পর এক মাস অতিক্রম করে অগাস্ট চলছে। বেড়ানোর নাম মুখে আনছে না কেউ। পোনা মাছের পাতলা ঝোল সঙ্গে ঝিঙে আলু পোস্ত, মুগের ডাল দিয়ে ভাত খাচ্ছেন। বাইরে বের হবার আগে মাস্ক সঙ্গে স্যানিটাইজার নিতে ভুলছে না। সাপ্তাহিক লকডাউনের ভিড়েও ঘুরতে না গিয়ে বাড়িতে থাকাটা কায়দা করে শিখে ফেলেছে ভ্রমণ রসিক বাঙালি।

মার্চ মাসের গরমের মধ্যেই পাহাড়ে না ছুটে বাড়িতে থেকেছে। জুলাই অগাস্ট মাসের একটানা বৃষ্টিতে মূর্তি নদীর পাশে গেস্ট হাউসে কাটানো অভিজ্ঞতা নিশ্চয় অনেকেরই স্মৃতিতে এখনও জমে রয়েছে। নিউ জলপাইগুড়িগামী সমস্ত ট্রেনের রিজার্ভেশন তালিকায় দীর্ঘ ওয়েটিং লিস্ট ভরা থাকত দেখেও তৎকাল টিকিটে ঝুঁকতেন। মোটামুটি মাস পাঁচেক উত্তরবঙ্গ যাওয়া ভুলে গিয়েছে। রাশিয়া করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কার করার পরেও রাজ্যের মধ্যেও কোথাও বেড়াতে যাবে তেমন আশা করছেন না কেউই।

বর্ষার রিমঝিম ধারায় বাঙালির বরাবরের পছন্দের ডুয়ার্স। বৃষ্টির ছন্দে ডুয়ার্সের সৌন্দর্য তুলনাহীন। তিন মাসের জন্য তালা ঝুলিয়ে দেওয়া থাকুক জাতীয় উদ্যান এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলিতে। মূর্তি নদীর ধারে হেলান দেওয়া চেয়ারে বসে বর্ষার ডুয়ার্স দেখার মজাটাই আলাদা। দিনের শেষে পাহাড় আর সবুজের আবহে সূর্যাস্ত সমস্তকিছু কে এক লহমায় দূরে সরিয়ে দেয়। সেইসময় চতুর্দিকে মূর্তি নদী মোহময়ি রূপ ছড়াতে থাকে। অচেনা একঝাঁক পাখি উড়ে যায় ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে। এক অন্যন্য সুখের স্মৃতি।

কিন্তু লকডাউন শুরুর পর থেকে মারাত্মক লোকসানে ডুয়ার্সের পর্যটন ব্যবসায়ীরা। এখনও অধিকাংশ ছোট, মাঝারি হোটেল পর্যটক শূন্য। একি সঙ্গে থমকে গেছে গাড়ি চালক, হোটেল স্টাফদের জীবনের গতি। বাগডোগরা থেকে বিমান ধরা অথবা লাটাগুড়ি স্টেশনে ট্রেন ধরার তাড়া নেই। মাথা উঁচিয়ে থাকা গাছে আবেগ জড়ানো নিস্তব্ধতা ভেঙে দেয় পাখির কিচিরমিচির। সামসিং, সুনতালেখোলা নেচার ক্যাম্প, নেওড়া ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক, ঝালং, বিন্দু সব চেনা জায়গাগুলো পর্যটন শূন্য। ভরা মরসুমে নিঃসঙ্গ বেঞ্চির মতোই স্থানীয় পর্যটন সুনশান-নিস্তব্ধ। কিন্তু কতদিন বাঙালি উত্তরের মুখি হবে না। লাফিয়ে ছুটে চলা পাহাড়ী নদীতে মন তৃপ্ত করবে না।

রাস্তার দুপাশারি সবুজের ভিড়ে কতগুলো মাস হয়ে গেল বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারেনি। চা বাগানের বর্ণীলতা নয়নজুড়ে প্রশান্তির ছোঁয়া দেয়নি। জঙ্গলের মাঝে অচেনা ফুল দেখে ক্যামেরা বের করে ছবি তুলে নেওয়া হয়নি। দূরে গাছের মাথায় গ্রেটার র্যাকেটেড টেল ড্রংগো, গ্রে নাইট জার দেখা হয়নি। সুস্থ হয়ে উঠুক পৃথিবী। প্রেমের টানে বাঙালি ঠিক পৌঁছে যাবে প্রেমিক ডুয়ার্সের কাছে। তারপর পাথর ভরা মূর্তি নদীতে তৃপ্ত হওয়া। তারপর! রকি আইল্যান্ড। পরের দিন সামসিং, সুনতালেখোলা নেচার ক্যাম্প, নেওড়া ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক, ঝালং, বিন্দু সব দু-চোখ ভোরে দেখে নেবে বাঙালি। সঙ্গে রেখে দেবে মাস্ক এবং স্যানিটাইজার।
