রূপনারায়ণের গ্রাসে ঠাঁই হারিয়ে বিপন্ন বেড়াল, হাটগাছা গ্রামের বাসিন্দারা

কল্যাণ অধিকারী

বর্ষার জলের সঙ্গে পরিচয় হতেই রূপনারায়ণ এখন সপ্তমে।
নদী ভাঙনে সহায় সম্বল হারানোর চিন্তায় গ্রামবাসীরা।
বেড়াল এলাকার পাল পাড়া ও হাটগাছা এলাকায় মানুষের ঘরবাড়ি সমস্যার সম্মুখীন।
নদীর পাড়ের ভিটেমাটি ছেড়ে একপ্রকার বাধ্য হয়ে নতুন জায়গায় উঠে গিয়েছেন একাধিক পরিবার।
প্রশাসনের আশ্বাসে চিড়ে ভিজছে না। গ্রামবাসীরা নদীবাঁধ বাঁধা নিজেদের চোখে দেখতে চায়।

সকালে ঘুম ভেঙে চোখ খোলা থেকে রাতে ঘুমানোর সময় অবধি ওঁদের চোখের সামনে রূপনারায়ণ থাকে শান্ত। কিন্তু বর্ষার জলের সঙ্গে পরিচয় হলেই রূপনারায়ণ তখন সপ্তমে চড়ে বসে। তার উপর যদি বৃষ্টি ও কোটালের জলচ্ছাস থাকে তো দেখতে নেই। ভাটোরা-চিতনান এলাকার নদীবাঁধ উপচে রূপনারায়ণের জল গ্রামে ঢুকে যায়। কিন্তু আসল খেলাটা খেলে জল একটু কমলে। ভাঙন শুরু হয় গ্রামে। এভাবেই কৃষি জমি, বসত বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। একবার নয়, বার চারেক পিছিয়ে যেতে হয়েছে। কথা হচ্ছিল বেড়াল এলাকার পাল পাড়ার বাসিন্দা কাশিনাথ পালের সঙ্গে।

বর্ষার মাঝামাঝিতে রূপনারায়ণে ভাঙন, আমতা-২ ব্লকের বেড়াল গ্রামের মানুষ কোনও দিন দেখেনি! ঘোড়াবেড়িয়া চিতনান গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন বেড়াল এলাকার পাল পাড়া ও হাটগাছা এলাকায় মানুষের ঘরবাড়ি সমস্যার সম্মুখীন। রূপনারায়ণের ভাঙনে প্রায় ১ কিমি এলাকা নদীগর্ভে বিলিন হবার সম্ভাবনা। সেচ দপ্তর ভাঙন রোধে কোন কাজই করেনি বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। পিছিয়ে যেতে যেতে অনেকেই নদী তীরবর্তী এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছে। আর যারা যেতে পারেনি তারা ভুগছেন আতঙ্কে। এলাকাবাসীদের আশঙ্কা দ্রুত রক্ষণাবেক্ষণ না হলে এবার গোটা এলাকায় ব্যাপক ভাঙন হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। এ দিনও দু’টি পরিবার তাঁদের নদীর পাড়ের ভিটেমাটি ছেড়ে একপ্রকার বাধ্য হয়ে নতুন জায়গায় উঠে গিয়েছেন। না হলে পরিবার সমেত নদীগর্ভে হারিয়ে যেতে হবে। এই নিয়ে গত কয়েকদিনে সাতটি পরিবার অন্যত্র সরে গেছে বলে স্থানীয়রা জানান।

ঘোড়াবেড়িয়া চিতনান গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান সাবিনা বেগম জানান, ওই এলাকায় ভাঙন অনেক দিনের সমস্যা, আমরা সেচ দপ্তর ও জেলা প্রশাসনকে বলেছি যাতে কংক্রিটের বাঁধ নির্মাণ করা যায়। এই আশ্বাসে অবশ্য চিড়ে ভিজছে না। গ্রামবাসীদের বক্তব্য, প্রতিবছর ভাঙছে সরকার দেখছে কোথায়! একবার নয় তিন-তিনবার বাড়িঘর ভেঙে পিছিয়ে অন্যত্র এসেছি। রান্নাঘর, গোলা ঘর, থাকার ঘর সব ছেড়ে এখন ত্রিপলের ছাউনি ঘরেতে উঠতে হয়েছে। আমাদের তো নিজেদের জায়গা নেই যে অন্যত্র উঠে যাব। নদীবাঁধে ত্রিপলের ছাউনি ঘরে থাকতে হচ্ছে। তবে ভয় ডিভিসি জল ছাড়লে। কখন যে ধস নেবে কেউ জানে না। রাতে ঘুমিয়ে আছি হুড়মুড়িয়ে ধস নেবে। কীভাবে রক্ষা পাব তখন জানেনা কেউ। ভয়াবহ অবস্থায় এলাকার মানুষজন। আমফান ঘূর্নিঝড়-এর সময় নদীর জল মানুষের ঘরের চৌকাঠে পৌঁছে গিয়েছিল। এলাকার মানুষজনকে ত্রাণ শিবিরে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর যেই কে সেই। আবার নদী ভাঙন শুরু হয়েছে।

আমতা বিধানসভার বিধায়ক অসিত মিত্র বলেন, “চিতনান, বেড়াল, হাটগাছা, দক্ষিণ ভাটোরা, উত্তর ভাটোরার কিছু অংশে নদীর পাড় ভাঙছে। ইতিমধ্যে ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁদের কাছে লিখিত দিয়েছি অবিলম্বে এইকাজ শুরুর জন্য। চিতনান, বেড়াল, হাটগাছা এই সমস্ত এলাকা অবিলম্বে বাঁধ বাঁধার কাজ শুরু হোক। নইলে বড়সড় ক্ষতি হয়ে যাবে। মুন্ডেশ্বরী নদী ও হুড়হুড়িয়া খালের পাশেও নদীবাঁধ ভাঙনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অবিলম্বে নদীবাঁধ ভাঙন না রুখলে হাজার হাজার মানুষজন সমস্যার মধ্যে পড়বে।”

ত্রিপলের ছাউনির উল্টোদিক থেকে তামাটে শরীর আর গাল বসে যাওয়া মুখে, অপলক দু’টি চোখ তাকিয়ে আছে প্রশাসনের দিকে। তাঁরা যে এবার কাজ চায়। ফেলে–আসা দিনগুলোর দিকে আর তাকাতে চায় না। জমি-বাড়ির সবটুকু গিলে খেয়েছে রূপনারায়ণ। ওঁরা প্রশাসনের জবাবের অপেক্ষায়। জমি নেই, কাজ নেই, বসত ভিটে সেটাও নদীগর্ভে চলে যেতে বসেছে। এসব ভেবে রাতে ঘুম চলে গেছে সত্তর বছরের বৃদ্ধের। ভোরের দিকে একটু চোখ বুজে আসে। সকাল হবার আগেই ঘুম ভেঙে যায়। এই হয়তো ভেঙে দিল ঘর। ভেসে যাচ্ছে ঘরের খড়কুটোর চালা। এই চিন্তা মাথায় দিনরাত ঘুরপাক খায়। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়, তার পর আর ঘুম আসতেই চায় না। কথাগুলো বলে চলেছেন পাল পাড়ার বৃদ্ধ। নাম লিখে আর কি করবে। এবার তো ভগবানের কাছে নাম লেখাতে চলেছি! তারপর যদি ওঁদের ঘুম ভাঙে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *