শান্ত ও বিনয়ী প্রণব বাবুর চোখদুটো রাজনীতির রং দেখতো না, দেশ হারালো প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতিকে
কল্যাণ অধিকারী
০ সোমবার বিকেলে প্রয়াত হলেন সমগ্র দেশের কাছে নিরঙ্কুশ প্রশংসা পাওয়া দেশের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়।
০ বীরভূমের গ্রামের ছেলে প্রণব মুখোপাধ্যায় দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন কালিমাহীন।
০ কলেজ জীবন থেকে রাষ্ট্রপতি প্রতিটি মুহূর্তে ছিলেন খুবই শান্ত এবং বিনয়ী।
০ কর্মজীবনে হাওড়া জেলার সঙ্গে ছিলেন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। ১৯৫৭ সালে ‘তাজপুর এম.এন.রায় ইনস্টিটিউশন’-এ মাস ছয়েক শিক্ষকতা করেছিলেন। হাওড়া বাঁকড়া ইসলামিয়া হাইস্কুল’-এ দু’বছর শিক্ষকতা করেছেন।
০ অপ্রত্যাশিতভাবে ২০২০ তে আমাদের হারাতে হলো বাংলার এক দাদাকে।

পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাইসিনা হিলস। বীরভূমের গ্রামের ছেলে প্রণব মুখোপাধ্যায় বাংলা শুধু নয় সমগ্র দেশের কাছে নিরঙ্কুশ প্রশংসা পাওয়া একজন আবেগের বাঙালি।
করোনা আবহে এই বাংলায় বসে এমন কত মৃত্যুশোকই না আমাদের শুনতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পরিজন, প্রতিবেশী থেকে পেশার জগতের বন্ধু। আবার প্রণব বাবুর মতন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। একটু দূরের, কিন্তু অনেক কাছের মানুষজন ছিলেন। সোমবার বিকেলে প্রয়াত হবার কথাটা শুনে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠেছে চিন্তিত মাথাটা। মৃত্যুশোক হয়তো এভাবেই হঠাৎ করেই চলে আসে। কিছুটা সময় মাথাটা চিনচিন করছিল। বাঙালি তো হৃদয়কেন্দিক সেন্টিমেন্টকে চোখের জলে প্রকাশ করে। একজন দাদা, একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতির চলে যাওয়াটা প্রত্যেকের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল।

চলতি মাসের ৯তারিখ বাথরুমে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। সেইথেকে চিকিৎসা চলছিল দিল্লির আর্মি রিসার্চ অ্যান্ড রেফারাল হাসপাতালে। ২২ দিনের লড়াইয়ের শেষে সোমবার বিকেল ৫টা পয়তাল্লিশ মিনিটে তাঁর মৃত্যুসংবাদ জানিয়েছেন ছেলে ও প্রাক্তন সাংসদ অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। ১৯৩৫ সালে ১১ ডিসেম্বর ভারতের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জন্ম হয় কৃষি ভিত্তিক জেলা বীরভূমের কীর্ণাহার শহরের নিকটস্থ মিরাটি গ্রামে। পিতা ছিলেন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায়। তফসিলি ও উপজাতি অধ্যুষিত জেলা থেকেই জীবনের লড়াই শুরু করেছিলেন প্রণব বাবু।
সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র ছিলেন। এই কলেজটি সেই সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল। তারপর একজন কলেজশিক্ষক রূপে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। পরে সাংবাদিকের কাজও করেন কিছুকাল। এই সময় তিনি ‘দেশের ডাক’ নামে একটি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এছাড়াও তিনি ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ট্রাস্টি ও পরে নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য’ সম্মেলনের সভাপতিও হন। প্রণব মুখোপাধ্যায় কর্মজীবনে ১৯৫৭ সালে ‘তাজপুর এম এন রায় ইনস্টিটিউশন’-এ মাস ছয়েক শিক্ষকতা করেছিলেন। হাওড়া বাঁকড়ায় অবস্থিত ‘বাঁকড়া ইসলামিয়া হাইস্কুল’-এ দু’বছর শিক্ষকতা করেছেন।

প্রণব মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবন দীর্ঘদিনের। প্রায় পাঁচ দশক ভারতীয় সংসদের সদস্য। ১৯৬৯ সালে তিনি প্রথম বার কংগ্রেস দলের প্রতিনিধিস্বরূপ রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭৫, ১৯৮১, ১৯৯৩ এবং ১৯৯৯ সালে তিনি রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে কেন্দ্রীয় শিল্পোন্নয়ন উপমন্ত্রী হিসেবে তিনি প্রথম ক্যাবিনেটে যোগদান করেন। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৫-৯৬ সালে তিনি পি. ভি. নরসিমা রাওয়ের মন্ত্রিসভায় বিদেশমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ সাংসদ পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০১২ সালের২৫ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন প্রথম বাঙালি প্রণব মুখোপাধ্যায়।
গত ৯ অগাস্ট বাড়ির শৌচাগারে পড়ে গিয়ে মাথায় চোট লাগে তাঁর। দিল্লির আর্মি রিসার্চ অ্যান্ড রেফারাল হাসপাতালে তাঁর মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। তখন থেকেই তাঁর অবস্থা ছিল সংকটজনক। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এবং অস্ত্রোপচার, একিসঙ্গে করোনা সংক্রমণ নিয়ে তিন সপ্তাহ হাসপাতালে লড়াই চালিয়েছেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কালিমাহীন ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। রাজনৈতিক জীবনে হাসিখুশি ভরা চোখদুটো রাজনীতির রং দেখতো না। শেষমেশ সোমবার বিকেলে এমন-ই এক শান্ত এবং বিনয়ী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জীবনের সমস্ত লড়াই থেমে গেল। ৮৪ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন দেশের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়।

ছবিঃ সংগৃহীত।