জঙ্গল ‘সুন্দরী’ নমিতা
কল্যাণ অধিকারী, এডিটর রাজন্যা নিউজ
বেলা বাড়ছে, দুপাশারি গাছের মাঝে ফাঁকা সড়ক ধরে এগিয়ে চলেছি। দূরে টিনের ছাউনি গুমটি দেখে বাইক থামালাম। মগে রাখা জল নিয়ে হাত ধুয়ে বসে পড়লাম বাঁশের লম্বা বেঞ্চে। থালায় মুড়ি তার উপর ঘুগনি ঢেলে দিলেন বছর পঁয়ত্রিশের নমিতা। ডিম ভেজে দেব কথাটা শুনেই ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলাম। এ তল্লাটে একটাই চায়ের দোকান। সকালের দিকে ঘুগনি আর মুড়ি। বিকেলের পর থেকে গরম-গরম আলুর চপ ভাজা হয়।
ডিম ভাজা হয়ে যেতেই জল ঢেলে নিবিয়ে দিলেন উনুন। এখুনি…। এদিকে বেলায় লোকজনের দেখা মেলে কম। ট্রেন-বাস চলে না ঠিকঠাক। দেখতেই তো পাচ্ছ লোকজন কোথায়। বিকেলে আবার জ্বালানো হবে। একদিন এই পথ দিয়ে যাবার সময় মনে হত ফেরার পথে বিপদ ঘনাবে না তো! বদলে যাওয়া জঙ্গলমহলে শান্তির মাদল বাজছে। পুজো শুরুর পথে। আপনাদের এখানে এবার কেমন হচ্ছে পুজো? কতদিন পরে আবার এলাম। কথাগুলো বলে চলেছি। এক এক করে জবাব দিয়ে যাচ্ছে লাল পেড়ে সুতির কাপড় পরা নমিতা মাসি।
সদ্য বর্ষায় যৌবনের তৃপ্তি মেটানো নদী অনেকটাই শান্ত। নদীর চর ঘেঁষা পথ দিয়ে গোকুল মাইতির ঘর। পাশেই পাতিলেবুর গাছ। তার পাশেই অষ্ট মাইতির মন্দির বানানো হয়েছে। প্রতিদিন সকাল-সন্ধে ধূপ দিয়ে মাথা ঠেকায় বাড়ির একমাত্র গৃহিণী নমিতা। শাশুড়ির নীরব কথাগুলো শুনতে পায় সে! রোজগেরে স্বামীর পা ভাঙা। কোনরকমে গরুর খাবার জোগার করে। সকাল-সন্ধে দোকান চালিয়েও বাড়ির মঙ্গলে সমস্ত ব্রত করেন। গত অমাবস্যায় নিঢাল উপোস থেকেছে। তারপর দরজার শিকল তুলে দোকানে ঘুগনি বানিয়েছে।
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আকাশেও মেঘ। এগোতে হবে এখুনি। রাঙ্গালু কটা নিয়ে যাও সময় করে খেয়ে নিও। অচেনা গ্রামের বৃহৎ জগতের মহিলা। মাথায় কাপড় দেওয়া। হাতের দুগাছা চুরি, রং ফিকে হয়ে গেছে। হয়তো হাটে গিয়েছিল কিনে পরেছে। তারপর থেকে এভাবেই হাতে জায়গা দখল করে রয়েছে। শরীরে খেটে খাওয়ার দীপ্ত ইচ্ছা। হৃদয়ে মানবিকতার শাসন ভরা। যা সর্বদা বাহির হতে চায়। অচেনা গ্রামের মানুষ দেখলে কাজল কালো চোখ বুঝে নিতে একদন্ড দেরি করে না। কেউ মনে রাখে, কেউ বা ভুলে যায় সাদামাঠা আটপৌরে নমিতাদের।
গাছের পাতা ঝরে দোকানের চাল ভরেছে। কবে না কোনদিন ভেঙে পড়ে, কথাটা শুনে থমকে যায়। বিয়ের পর থেকে অর্ধেক জীবন এই দোকানেই কাটাচ্ছি। আর যাবার কি আছে। শরীরের মতন নড়বড়ে হচ্ছে দোকানটাও। দুর্গা-দুর্গা করে কাটিয়ে দিই। এগিয়ে চলেছি চকচকে পথ ধরে। এমন বাদলা দিনে শহরের সুউচ্চ ফ্ল্যাটের বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে মেঘ দেখে কিশোরী। দেড়শো কিমি দূরে জীবনের সবকটা বসন্ত বিবর্ণ করে স্বামীর মুখে ভাত তুলে দিতে দোকান চালাচ্ছে। কাগজের নৌকা নয়, বর্ষায় বাঁধ উপচে জল চলে আসে দোরগোড়ায়। নৌকায় করেই যাতায়াত করতে হয়। তবুও কিছু পাওয়ার জন্য ওঠে না গর্জে।
বৃষ্টি পড়ছে। হেলমেটের সামনের কাঁচ ভিজে ঝাপসা করে দিচ্ছে সামনের পথটা। অর্ধেক জগত দেখে এগিয়ে চলেছি প্রতিদিনের কর্মের কোটা সম্পূর্ণ করতে। এখানকার জঙ্গলে হাতির পায়ের ছাপ চাপা পড়ছে নমিতাদের লড়াইয়ের কাছে। সকালের প্রথম আলোয় পিয়াল ফুল সুর ধরে। সন্ধ্যায় জ্বালানো প্রদীপ উজ্জ্বল করে দেয় কনকচাঁপার সুবাস। আলপনা দেওয়া চণ্ডীমণ্ডপের মাটির দেওয়ালে লেখা একরাশ এলোমেলো স্মৃতি জ্বলজ্বল করতে থাকে। গ্রামের মেলায় প্রথম পেমের শুরু। টিকলি কিনে দিয়েছিল গোকুল। হ্যারিকেনের আলোয় ব্যাগ থেকে বার করে বেশ কয়েকবার হাত বুলিয়েছিল টিকলিটায়।
কোন এক বসন্তের জ্যোৎস্না রাতে বন ফুলের গন্ধে যখন জঙ্গল মম করছে, শক্ত বিছানায় আঁচল পেতে স্বামীর শরীরী পরশ প্রথম মেখেছিল শ্যামলা গায়ের মেয়েটি। কয়েক মিনিটের কামনায় চোখ বুজিয়ে দিয়েছিল কিশোরী। তারপর থেকে প্রতিটি রাত নাকে গেছে মহুয়ার গন্ধ। এতেই স্বামীর অস্তিত্ব বিছানায় টের পেয়েছে। আজ শরীরের প্রখরতা অনেকটাই হারিয়েছে। দুর্গম পথ এখন রুদ্র। আঁচল কোমরে বেঁধে স্বামীর সংসার সামলে এগিয়ে চলেছে আজকের নমিতা।
ছবি কল্যাণ অধিকারী।