ঋতুস্রাবে কাপড় দেওয়া ‘ওঁরা’ সভ্যতার নবজাগরণ

কল্যাণ অধিকারী

পাঁশকুড়া ছেড়ে বাসের গতি তখন একশো পার করেছে। মহিলা যাত্রীর দু’চোখের পাতা এক। পাশে বসা সঙ্গী কিপ্যাড মোবাইল বের করে সময় দেখে চোখ বোজাল।

কিছু অপরিচিত মুখ বাসের সিটে বসে। বয়সের তুলনায় শরীরের ধকল একটু বেশিই সহ্য করেছে। কানের পাশ দিয়ে নেমে গেছে কটা লম্বা চুল। শ্যামাঙ্গিনী শরীরে প্রেমের পাট চুকিয়েছে। গোড়ালি ফাটা ওদের পায়ে অনেকটা পথ চলার ক্ষমতা। পোয়াতি হওয়ায় পেট কিছুটা ফুলে। সভ্যতার মাঝে কাপড় ঢেকে রেখেছে।
বাসের হর্নে মাঝেমধ্যে ঘুমটা ভাঙছে। জাতীয় সড়কের দু’পাশে গজিয়ে ওঠা পার্থেনিয়াম গাড়ির হাওয়ায় গা দোলাচ্ছে। পিছিয়ে যাচ্ছে মেহগিনি, বনশাল, ইউক্যালিপটাস গাছ। শুধু এগিয়ে চলেছে বাসে বসা ওঁরা। লাল মাটির মোরাম রাস্তার পাশে জঙ্গল ঘেরা গ্রামে ওঁদের ঘর। ঋতুস্রাবের সময় কাপড়চোপড় দিয়ে ক’টা দিন কাটিয়ে দেয়।

তারপর! যদি ডাক আসে কাজের। ওইভাবেই কাজ করে যায়। তারপর রাতে আলু ভাতে মাখা মোটা চালের ভাত খেয়ে পেট ভরায়। শক্ত বিছানায় যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া শরীরে ঠেলা দেয় গতরখেকো মঙ্গলের বাপ। ছোট থেকেই সহ্য করতে ওরা শিখেছে। হয়তো সহ্য করাটাই জীবন!
উন্নাওয়ে কি ঘটেছে। দেশের আরও এক মেয়ের শরীর খুবলে খেয়েছে রাজনৈতিক নেতা। প্রমাণ সরাতে ট্রাক দিয়ে পিষে মারতে চেয়েছে। মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে মেয়েটি। এসবের খোঁজখবর এরা কম রাখে। জীবনে টিকে থাকার লড়াই চালাতে ওঁরা সব পারে। ওঁদের সব পারতে হয়।

এদের পরিচিত কোনও স্বজন পিঁপড়ের ডিম খেয়েছে। আবার জঙ্গল পার্টির হয়ে রাস্তা কেটেছে। দিতে হয়েছে সতীত্ব বিসর্জন! রাত কাটাতে হয়েছে শুকনো পাতার উপরই দস্যুদের পাশে শুয়ে! ভোরের আলো ফোটার আগে ঘরে ফিরে শুদ্ধতার পুকুরে ডুবিয়েছে শরীর। তারপর বনফুল তুলে চড়িয়েছে দেবতার চরণে।
লাল রঙের হরহরে কাপড় নেমে গিয়েছে বুকের কাছে। ঘুমে ভাড়ি চোখে পাতা খোলবার ক্ষমতা যেন শিকল টানা। বার কয়েক সেদিকেই তাকিয়েছে সভ্যতার শহর। লকলকে জিভ চেটেছিল ঠোঁট। ছুঁতে চেয়েছিল উঁকি দেওয়া শরীর! গায়ের রঙে তখন কি যায় আসে। ধর্ম এক হলেই উঁচুনিচু, বাদ-বিচার কে তখন করে!

যে মেয়ে রাতের পর রাত জেগে শালপাতার থালা বানায়। দিনের আলোয় মাইলের পর মাইল মাথায় তুলে মহাজনের ঘরে দিয়ে আসে। তারপর যে ক’টা টাকা মেলে। বাজার থেকে সবজি, আলু সঙ্গে একটু মাছ কিনে আনে। মাটির হাড়িতে টগবগিয়ে ফুটতে থাকা ভাত নামিয়ে, মাছের ঝাল ও লাউডগ, বিউলির ডালের বড়ি দিয়ে বানানো সবজি গোগ্রাসে পেটে চালিত হচ্ছে।

বাসে বক্সে বাজছে ‘তুঝে বিন জানে, বিন পহচানে, ম্যয়নে হৃদয় সে লগায়া’। চোখ খুলে তাকিয়ে ইয়ে কি হইলো তোমার বেলপাহাড়ি এসে পড়লো যে উঠো এবার। লামতে হবে যে। কাপড় গুছিয়ে বাস থেকে নেমে পড়লো একটা সভ্যতা। শক্ত মাটিতে গড়ানের ডিঙি চালানো ওঁরা শিক্ষিত সভ্যতার অনেক মাইল দূরে থেকে এক নবজাগরণ।

ছবিঃ প্রতীকী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *