হৃদয়ের ভক্তি দিয়েই দুর্গা গড়ে বিজয়-ময়না
দীপিকা অধিকারী
সে রাতে ঘুম এসেছিল অনেক পরে। শত চিন্তার ভিড়ে মিশেছিল প্রতিমাকে নিয়ে অল্প একটু আনন্দ। ঘুম ভাঙ্গার পর থেকে রাতে ঘুমানো পর্যন্ত একটাই চিন্তা মাথায় ঘোরে সময়ে প্রতিমা দিতে পারব তো! পুজোর তিনমাস আগে থেকে প্রতিমার কাঠামো তৈরি শুরু করে দেন দামোদরের পাড় ঘেঁষা গ্রামের শিল্পী বিজয়। সময় যত এগিয়ে আসে নাওয়া খাওয়া ভুলে যেতে হয়।
আকাশের মুখ ভার দেখলেই পুজো উদ্যোক্তাদের ঘনঘন ফোন আসা শুরু করে। কার্তিক-গণেশ থেকে দুর্গা প্রত্যেকের গায়ের মাটি ঘষে সমান করে তারপর চুন মাখানোর কাজ চলে। প্রতিমার রঙ গায়ে-হাতে লেগে থাকে। এবছর প্রথমবার কাজে হাত দিয়েছে ময়না। বিয়ের পর একচালা ঘরে আসার পর থেকে সংসারের সমস্তটা নিজের হাতে সামলে চলেছে। রান্না করা, ঘর মোছা সব ওই করে। ঝড়বৃষ্টি হলে দুমানুষে মাটির ঘরে খুঁটি ধরে বসে থাকতে হয়। নদীর পাড়ে ঘর। বছরভর বিপদের সম্মুখীন। তারপরেও দুজনের আদরে আবদারে সংসারে রোদ ঝলমল করে।
দুপুরে এই কদিন মাছ বাদ দিয়েই নিরামিষ ভাত-সবজি খাচ্ছে। মাছের কাঁটা ছাড়াতে গিয়ে সময় লাগছে বেশি। ততটা সময় প্রতিমা গড়তে দিলে কাজটা এগোবে। হঠাত করেই ময়নার ইচ্ছে হয়েছে, অষ্টমীতে বাপের ঘর যাবে। কতগুলো বছর হয়ে গেল বাবা মারা গিয়েছে। মায়ের শরীর খুব একটা ভাল যাচ্ছে না। পঞ্চমীতে সমস্ত ঠাকুর উদ্যোক্তাদের দিয়ে তবেই ফুরসৎ মিলবে। দুমানুষে নদীর পাড়ে বসে কাশফুল দেখবে।
ভাদ্র মাসের শুরু থেকেই নদীর পাড়ে ভরেছে কাশফুল। ছেলে-মেয়েরা আসে ছবি তুলতে। ময়নার বিয়ে যখন হয়েছিল ওসব মোবাইল ছিল না। এক বিকেলে স্কুল থেকে ফিরতেই মা বলেছিল যা শাড়ি পড়ে নে। তোকে দেখতে চার কিমি দূরের ব্রাহ্মণ পরিবার এসেছে। বয়স সবে পনেরো স্বামীর হাত ধরে পালকি চড়ে শ্বশুর ঘরে প্রবেশ। পনেরো বছর হয়ে গেল বিয়ে হয়েছে। আজ পর্যন্ত দক্ষিণেশ্বরের কালীকে দেখে আসেনি। একবার গ্রাম থেকে বাস ছেড়েছিল। জোর করে মায়াপুর-তারাপিঠ গিয়েছিল। সেই প্রথম আর সেই শেষ।
দশটা গ্রামের প্রতিমার কাজ করে বিজয়। দুর্গার কাজ শেষ হলে কালী। তারমধ্যে কার্তিক, লক্ষ্মী ও সরস্বতী রয়েছে। সংসারে সুখ এনেছে দেবতাই। মাটির ঘরে থেকেও বড়-বড় মন্ডপে প্রতিমা গড়ে দিচ্ছে। এতেই বিজয়-ময়নার ঘরে শান্তি বিরাজ করছে। ঘুমের ঘোরেই বিড়বিড় করে ময়না।