করোনা আবহে ধুঁকছে শিল্প! অর্ডার নেই শিল্পের দেবতার, খরচ উঠবে তো চিন্তায় মৃৎশিল্পীরা
কল্যাণ অধিকারী
❏ শিল্পের দেবতার আরাধনার আটচল্লিশ ঘন্টা আগে মৃৎশিল্পীদের চরম ব্যস্ততা উধাও।
❏ জেলার শিল্পের চেহারা যেমন ফ্যাকাসে ঠিক তেমনই শিল্পের দেবতা পর্দার আড়ালে।
❏ ছোট-মাঝারি একাধিক কলকারখানা ঝাঁপ ফেলেছে। নমো-নমো করেই এবছর শিল্পের দেবতার আরাধনা করার চিন্তাভাবনা।
❏ মার্চ মাসে মাত্র চার ঘন্টার নোটিশে থমকে যাওয়া অর্থনীতি সচল হতে বহু সময় লাগতে পারে মনে করছেন অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা।
❏ বিশ্বকর্মা মুখ তুলে না চাইলে মাটির স্পর্শে রূপ দেওয়া মানুষের শিল্পীসত্তা হারিয়ে যেতে বসবে।
শাস্ত্রীয় মতে বুধবার সন্ধে থেকে শিল্পের দেবতা বিশ্বকর্মার আরাধনা শুরু হবে। তার আটচল্লিশ ঘন্টা আগে মৃৎশিল্পীদের চরম ব্যস্ততা উধাও। শিল্পের দেবতার চোখে তুলির টান দিচ্ছেন মৃৎশিল্পী। কোথাও আবার প্রতিমায় রঙের প্রলেপ পড়ছে। কিন্তু বিশ্বকর্মা পুজোর আগে চেনা ছন্দটা উধাও। জেলার শিল্পের চেহারা যেমন ফ্যাকাসে ঠিক তেমনই শিল্পের দেবতা পর্দার আড়ালে!
করোনা আবহে ছন্দহীন নগরী। চাকচিক্যহীন শ্রমিকদের জীবন। চেনা রুটিন বদলে স্যানিটাইজার ও মাস্ককে আপন করে নিয়েছে আম-জনতা। ছোট-মাঝারি একাধিক কলকারখানা ঝাঁপ ফেলেছে। যেগুলো খোলা রয়েছে কোনক্রমে আট ঘন্টা চলছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নমো-নমো করেই এবছর শিল্পের দেবতার আরাধনা করার চিন্তাভাবনা রয়েছে। শিল্পের পরিস্থিতি ক্রমশ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। বহু কারখানায় নতুন করে অর্ডার নেই। পুরনো অর্ডারের কাজ চলছে। শিল্পের মতো বিপর্যস্ত জেলার মৃৎশিল্পীরা। বুধবার সন্ধেবেলা থেকে বিশ্বকর্মা পুজো শুরু। সোমবার অবধি যে কয়েকটি বুকিং এসেছে তাও আবার ছোটখাটো প্রতিমার জন্য। যে প্রতিমাগুলো নির্মাণ করা হয়েছে বিক্রি না হলে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন মৃৎশিল্পীরা এমনটাই জানাচ্ছেন তাঁরা।
আমতা-ঝিকিরা সড়কের গায়ে জয়পুর কুন্দুলিয়া গ্রাম। এ গ্রামের মৃৎশিল্পী ঝন্টু দলুই। বহু বছর ধরে মৃৎশিল্পের কাজ করে আসছেন। এমন অসহায় পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি কখনও। গত বছর ৭০টি বড় সাইজের বিশ্বকর্মা বানিয়েছিলেন। একদিন আগেই অধিকাংশ প্রতিমা বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। এ বছর ছোট-বড় মিলিয়ে ৩৫টি প্রতিমা বানিয়েও অর্ডার মিলেছে সাকুল্যে পনেরটি। ঝন্টু বাবু জানান, অন্যান্য বছর এক এক জন প্রতিমা শিল্পীর কাছে প্রায় সত্তরটির মত প্রতিমার অর্ডার এসেছিল। একদিন আগে থেকে প্রতিমা কিনতে হিড়িক শুরু হয়ে যেত। কিন্তু সেই চেনা ছন্দ এবছর আর নেই। যে ক’টি অর্ডার এসেছে তাও ছোটখাটো প্রতিমার। অনেকেই প্রতিমার সাইজ ছোট চাইছে। কর্মচারীদের মাইনে, জিনিসপত্রর দাম সব বেড়ে গেছে। খরচ উঠলে হয়। এই চিন্তায় মাথায় হাত মৃৎশিল্পীদের।
দশনম্বর, আমতা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা, পাঁচলা, ধূলাগোড়, আলমপুর অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছোট-মাঝারি শিল্প ধুঁকছে। শিল্পের মতো বেহাল অবস্থা কর্মরত শ্রমিকদের। অনেকের দুমাসের মাইনে বকেয়া রয়েছে। বহু শ্রমিকদের ফোন করে বলা হয়েছে আসতে বললে তবেই কাজে আসার কথা। কাজ চলে যাওয়ায় রাস্তার পাশে ছোটখাটো দোকান বানিয়ে কোনক্রমে সংসার চালাচ্ছে। ফলে কাজকর্ম না থাকায় শিল্পের দেবতার আহ্বান কোনক্রমে করতে চাইছে মালিকপক্ষ। মার্চ মাসে মাত্র চার ঘন্টার নোটিশে থমকে যাওয়া অর্থনীতি সচল হতে বহু সময় লাগতে পারে মনে করছে অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা বিশেষজ্ঞদের একাংশ। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে শিল্পের দেবতার আহ্বানে আগাম প্রস্তুতি নেই বললেই চলে।
নীল রঙের আকাশজুড়ে সাদা মেঘে ভেসে বেড়াচ্ছে। হাওয়ায় দুলতে শুরু করেছে কাশফুল। বিশ্বকর্মা পুজোর সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত রাখা মহিষাসুরমর্দিনী শুরু হবার আগেও নেই উন্মাদনা। সাধারণ মানুষ করোনাভাইরাসকে দূরে সরিয়ে খাদ্যের সন্ধানে কাজে যাচ্ছে। আট ঘন্টা কাজ সেরে রাতে বাড়ি ফিরে আসছে। এবছর শিল্পের দেবতার আরাধনা কোনক্রমে সম্পূর্ণ করে জীবনযুদ্ধে রক্ষা পেতে চাইছে। কিন্তু ওঁরা! মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ওঁদের জীবন সংগ্রাম। বিশ্বকর্মা মুখ তুলে না চাইলে মাটির স্পর্শে রূপ দেওয়া মানুষের শিল্পীসত্তা হারিয়ে যেতে বসবে। লক্ষ লক্ষ বেকারদের তালিকায় নাম লেখাবে ওঁরা। চশমার কাঁচে চোখ স্থির রেখে শিল্পের দেবতার মুখাবয়ব আঁকছে। একিসঙ্গে নিজেদের জীবনের ইতিকথা।