চেনার ভিড়ে অন্য একুশে

কল্যাণ অধিকারী

অনন্ত দা তুমি কেমন মানুষ! কলমে যার লেখা বের হয়, সে বাংলা ভাষা তে কথা বলতে এত অশ্রাব্য শব্দ ব্যবহার করো কিভাবে! একটু তো সমাজের কথা ভাবো। কি শিখবে নব প্রজন্ম? থাম তো শেষ টুকু গলায় ঢালি আগে!

রিক্সা টানা মানুষ। ঘরে আছে সাদা কাপড় পরা মা। উনুনে কাঠ ঠেলে ভাত রাঁধলে ছেলে অনন্ত দুপুরে ঘরে ফিরে তা খায়। আবার যখন রাতে ফেরে তখন শান্ত এলাকা। রিক্সার ক্যাঁচ ক্যাঁচ চেনের আওয়াজ দূর অবধি ভেসে যায়। ঘুপচি ঘরের দুয়ার রাতের বিছানা। ওখানেই রাত টুকু কাটিয়ে দেয়। মদের গন্ধে মশাও একটা সময় হয়ে পরে নেশাগ্রস্থ। তবুও মাকে শুতে দেয় ঘরে কাঠ পাতা তকতায় কাঁথা কম্বল মিলে।

এই যে রিক্সা, যাবে মোড় মাথা? অনন্ত গামছা কাঁধে ফেলে এগিয়ে চলে। টোটোর দাপটে কারবার এখন টিমটিম করছে। তবুও রিক্সা চালিয়ে শেষ সময়টা কাটাতে চায় অনন্ত। পিছনে সুদর্শনা যাত্রী দেখে অনেকে অনন্ত’র কারবারে আলো দেখতে পেয়েছে। কেউ বলছে আজ অনন্ত দু পেগ বেশি-ই খাবে!

দশ টাকা ভাড়া দিয়ে নেমে যায়। বসন্তের দুপুরে রিক্সা নিয়ে গাছের তলায় পৌঁছায়। বসার সিটের নিচে বাক্সে রাখা কটা কাগজ বের করে। কিন্তু দূরে ছুটতে ছুটতে এগিয়ে আসা কিছু লোককে দেখে কাগজ গুলো সিটের নিচে রেখে দেয়। এই তুই পাচারের কাজ করিস। মার-মার বলতে বলতেই শুরু করে দেয় মার।

এলোপাথাড়ি মারধরের মাঝে একজন সিটের নিচ থেকে কাগজের কটা পৃষ্ঠা বের করে। ধুস কি সব লেখা! চল চল এ নয় ভুল তথ্য ছিল। ঠোঁটের কোল বেয়ে গড়িয়ে আসছে তাজা রক্ত। কোনক্রমে সোজা হয়ে কাগজের পৃষ্ঠা গুলো কুড়িয়ে রিক্সার পিছনের সিটের নিচে গুছিয়ে রাখে। হ্যান্ডেল ধরে এগিয়ে যেতে থাকে অনন্ত।

হে রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, কালিকা প্রসাদ আমি আজ এক নবজাগরণ দেখলাম। সৃষ্টি কে হাতলে এগিয়ে চলা সমাজের নগ্ন রূপের সাক্ষাৎ হলাম। আশীর্বাদ যদি থাকে তা একান্তই ওই ছিটেবেড়া ঘরে বাস করা সাদা কাপড় পড়া মাতৃত্বর। দাইমা নাড়ি ছিঁড়ে বলেছিল এ ছেলে খেটে খাওয়াবে। আজ কবিতার পাতা ধরে বলতে ইচ্ছে হয়। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙা একুশে। আমি কি ভুলতে পারি।

একটা সময় ছিল যখন খুলনায় থাকতো।বাবা-মা এর সাথে রিক্সা চেপে কক্সবাজারে যেত। বড় হবার আগে-ই নেমে এলো আক্রমণ। বাবাকে ছেড়ে মায়ের কোলে চেপে এগিয়ে গিয়েছিল। ছোট হাতে গোলাপ নিয়ে ঘুমিয়ে পরেছিল কখন। ইছামতী পার করে এক ভোরে পা রাখা ভারতে। সে সব স্মৃতি আজও ভোলে নি। পুরনো দিনে রিক্সা চাপার ইচ্ছেটাই এখন পেশায় পরিণত।

মদের গ্লাসের শেষ টুকু গলায় ঢেলে রিক্সার সিট তুলে কাগজের পাতা গুলো নিয়ে কবিতা লিখতে শুরু করে। নীরব রাতের পাঠ শোনাচ্ছে ঝিঁঝিঁ পোকা। আলো দেখাচ্ছে জোনাকি। অন্ধকার গায়ে চড়িয়েছে কম্বল। ভাইয়ের রক্তের রঙ কাগজে চড়িয়ে লেখে অনেক কিছু। যার স্থান হয় না বড়ো কোন পত্রিকায় বা কবিতার বইয়ে। মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে মাইক হাতে নিয়ে বলতে কেউ ডাকে না। সবটাই নাক উঁচু সমাজের বিভেদ। একজন রিক্সাওয়ালা মঞ্চে উঠে কবিতা পাঠ করবে এটা মানা যায় না। তবুও অনন্ত লিখতে থাকে। ওর দেহে যে আঁকা আছে ভাইয়ের ক্ষত!

‘দোপাটি মুছে দেয় নরম দূর্বায়
লেগে থাকা রক্তের লাল দাগ।
কপালের তিলকে লাল চিহ্ন
তবুও বলে ওঠে,
বাংলা ভাষা বিশ্ব বরেণ্য হবে একদিন,
সে দিন মোছাবে এ দেহে-
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি,
আমি কি ভুলিতে পারি’।

চিত্র সৌজন্যে গুগল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *