হামাস-ইসরায়েল শান্তিচুক্তি ঘোষণা, উল্লাসে গাজাবাসী

রাজন্যা নিউজ ব্যুরো

অবশেষে হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে শান্তিচুক্তি হয়েছে। উভয়পক্ষ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ঘোষণা করেছেন। ট্রাম্প তাঁর সামাজিক মাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ লিখেছেন, এর মানে, সব বন্দীদের খুব শীঘ্রই মুক্তি দেওয়া হবে। ইসরাইল সম্মত সীমারেখা পর্যন্ত সেনা প্রত্যাহার করবে। হামাসও চুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছে এবং ট্রাম্প ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে আহ্বান জানিয়েছে যেন তারা ইসরাইলকে চুক্তির সব শর্ত পূর্ণভাবে মেনে চলতে বাধ্য করে।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই চুক্তিকে ইসরাইলের জন্য এক মহান দিন বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভা বৈঠক ডেকে চুক্তির সরকারি অনুমোদন দেবেন বলে জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, যদি এই চুক্তি টিকে থাকে, তবে এটি ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের সবচেয়ে বড় পররাষ্ট্রনীতিগত সাফল্য হিসেবে গণ্য হবে বলে। এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে মিশরে, ইসরাইল গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করার দুই বছর দুই দিন পর। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস-নেতৃত্বাধীন হামলায় ইসরাইলে প্রায় ১,২০০ জন নিহত হয়। ২৫১ জনকে বন্দি করা হয়। এর পর থেকে ইসরাইলের সামরিক অভিযানে গাজায় কমপক্ষে ৬৭,১৮৩ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ২০,১৭৯ জন শিশু রয়েছে বলে জানিয়েছে হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রক।
খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো গাজাজুড়ে অভুক্ত, যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষের মধ্যে আনন্দ দেখা দিয়েছে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে হামাসের হাতে বন্দি ইসরাইলিদের পরিবারগুলো। তাদেরকেও তেল আবিবে আনন্দ করতে দেখা গেছে। এসব পরিবারের একজন অন্যজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। তিনটি দফায় গাজা থেকে ইসরাইলের সেনা প্রত্যাহারের কথা বলা হয়েছে চুক্তিতে। কিন্তু এরপর গাজার ভবিষ্যত কেমন হবে? এ প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই এই মুহূর্তে।
তাদের এক দীর্ঘ প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরাইলি ড্রোন ও যুদ্ধবিমানের গুঞ্জনের মধ্যে জিহান আবু মানদিল দেখছিলেন, তার পাঁচটি ছোট সন্তান দেইর আল-বালাহর এক ক্ষুদ্র, অস্থায়ী তাঁবুর ভেতর খেলছে। গণহত্যার মাঝেও অবরুদ্ধ গাজার আকাশের নিচে সেটি ছিল একটুখানি শৈশবের মুহূর্ত। রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিশেষজ্ঞ এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ জেনোসাইড স্কলার্স ইসরাইলের এই অভিযানকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তারা বলেছে, ইসরাইল গাজার প্রায় সবকিছু ধ্বংস করেছে। এর মধ্যে আছে হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, গোটা পাড়া-মহল্লা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ৯০ শতাংশ ভবন ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ইসরাইল কমপক্ষে ৬৭,১৬০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। ১,৬৯,০০০ জনকে আহত করেছে। আরও হাজার হাজার লাশ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে।
গাজার মানুষরা এখনও আশার আঁচ ধরে রেখেছে। গত দুই বছরে বহুবার মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা ভেস্তে দিয়েছে ইসরাইল। তবে এবার ট্রাম্প কিছুটা বেশি চাপ প্রয়োগ করেছেন। যদি এই যুদ্ধবিরতি টেকসই হয়ও, গাজার সামনে অপেক্ষা করছে ভয়াবহ পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ। রাষ্ট্রসঙ্ঘের হিসাব অনুযায়ী, গাজা পুনর্র্নিমাণে লাগবে ৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ। সময় লাগবে কমপক্ষে ১৫ বছর সময়, যাতে অঞ্চলটি আবার বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। তবে এই হিসাব কেবল তখনই প্রযোজ্য, যদি ইসরাইলের অবৈধ অবরোধ পুনর্গঠনে বড় বাধা না হয়। আগের ক্ষুদ্র যুদ্ধগুলোর পর বারবার তারা যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে। দোহায় অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ-এর গাজাবাসী বিশেষজ্ঞ আজমি কেশাওয়ি বলেন, গাজার মানুষ তাদের জীবন ফিরে পেতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে প্রস্তুত। কিন্তু শুধু ইচ্ছাশক্তি যথেষ্ট নয়। এটা শুধু তাদের ওপর নির্ভর করে না।
গাজার ভবিষ্যতের জন্য পুনর্গঠন যত জরুরি, ততটাই আশঙ্কা রয়েছে, যদি হামাস ক্ষমতা ছাড়ে (যা ট্রাম্পের প্রস্তাবের একটি ধারা), তাহলে অঞ্চলটি বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতার মধ্যে ডুবে যেতে পারে। গাজার সাংবাদিক ইয়াসের আল-বান্না ব্যাখ্যা করেন, হামাসের শাসনের একটি সুবিধা হলো তারা নিরাপত্তা বজায় রাখে।
২০০৬ সালে হামাস নির্বাচনে জয়ী হয়ে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের নেতৃত্ব নেওয়ার পর দুই দলের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ হামাসকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করে। কারণ তারা ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ ছাড়েনি। যুক্তরাষ্ট্র ফাতাহকে হামাস উৎখাতের জন্য সহায়তা করে। ফলে ২০০৭ সালের জুনে এক সংক্ষিপ্ত গৃহযুদ্ধের পর হামাস ফাতাহকে গাজা থেকে বিতাড়িত করে। এর পর থেকেই ফিলিস্তিন জাতীয় আন্দোলনে গভীর বিভাজন থেকে যায়।
যারা গাজায় রয়ে গেছেন, তাদের সামনে অপেক্ষা করছে মানসিক বিপর্যয়ের এক অনন্ত লড়াই। কেউই এখনও সময় পায়নি নিজের ক্ষতি বুঝে উঠতে। পরিবার, বন্ধু, ঘরবাড়ি, ভবিষ্যৎ সবকিছু হারিয়েছে ইসরাইলের নিরন্তর আক্রমণে। ২০২২ সালে, অর্থাৎ গণহত্যা শুরু হওয়ার আগেই, সেভ দ্য চিলড্রেনের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, গাজার প্রতি পাঁচজন শিশুর মধ্যে চারজনই বিষণ্ণতা, ভয় ও শোক নিয়ে বেঁচে আছে।
ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্স জানিয়েছে, সাম্প্রতিক ইতিহাসে এমন ভয়াবহ সম্মিলিত মানসিক ক্ষত আর দেখা যায়নি। সংস্থার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আহমদ মাহমুদ আল-সালেম আম্মান (জর্ডান)-এর এক ক্লিনিকে গাজার শিশুদের চিকিৎসা করতেন। তিনি দেখেছেন অধিকাংশ শিশু ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন, বিষণ্ণতা ও অনিদ্রায় ভুগছে। লন্ডনের ইনস্টিটিউট অব সাইকিয়াট্রির অধ্যাপক ডেরেক সামারফিল্ড আল জাজিরাকে বলেন, গাজার শিশুরা এখন যা পার করছে, তা কল্পনারও অতীত। কমপক্ষে ১৭,০০০ শিশু এখন একা। তাদের কোনো অভিভাবক নেই। তারা আদৌ কখনও নিরাপদ জীবনে ফিরতে পারবে কিনা, তা অনিশ্চিত। তিনি আরও বলেন, এই শিশুদের ভবিষ্যৎ তাদের মানসিক ট্রমা কাটিয়ে ওঠার ওপর নির্ভর করে না। কারণ ট্রমা তো এখনো শেষ হয়নি। তাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তাদের সমাজের ওপর। আর সেই সমাজই ধ্বংস হয়ে গেছে। এ কারণেই এটাকে আমরা গণহত্যা বলি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *